
বাংলাদেশের বর্তমান সময়ে এক ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, যা সমাজ, রাষ্ট্র এবং মানবতার ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এটি আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ ব্যর্থতার প্রতীক। আমাদের সমাজে আজ ‘জনতা’ নামের এক উন্মাদ শক্তির উত্থান ঘটেছে, যারা নিজেদের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে, মানুষকে প্রকাশ্যে নির্যাতন ও হত্যা করছে এবং মানবিকতার সব সীমা অতিক্রম করছে। ‘মব’ এখন সামাজিক জীবনের এক বিভীষিকাময় বাস্তবতা। উচ্ছৃঙ্খল জনতার একটি দল, যারা কখনো প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে, কখনো গুজবের প্রভাবে, আবার কখনো রাজনৈতিক ইন্ধনে খুন, চাঁদাবাজি, প্রকাশ্যে মারধর এবং ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হচ্ছে, যা রাষ্ট্রের জন্য এক মারাত্মক হুমকি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্বল বিচারব্যবস্থা এবং প্রশাসনের নীরবতা এ শক্তিকে আরও বেপরোয়া করেছে। ন্যায়বিচার না পেয়ে মানুষ নিজেরাই আইন হাতে তুলছে, যার ফল হচ্ছে অমানবিক সহিংসতা এবং নিরীহ মানুষের প্রাণহানি। বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি সময়েই রাজনৈতিক অস্থিরতা কোনো না কোনোভাবে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এ অস্থিরতা এক ভিন্ন চেহারা ধারণ করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা এবং বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা জনতার উত্থানকে উৎসাহিত করেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের সুযোগে এক নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটে, যারা নিজেদের ‘জনতা’ নামে পরিচিত করে। এ জনতা নিজেদের হাতে আইন তুলে নিয়ে নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। কোনো সন্দেহভাজনকে ধরার পর তাকে পুলিশে না দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে প্রকাশ্যে পেটানো হয়। হাতুড়ি দিয়ে তার হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয় এবং সেই ভয়াবহ দৃশ্য মানুষজন আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করে। অনেকে আবার মোবাইল ক্যামেরায় ভিডিও ধারণ করে লাইভ প্রচার করে। এমন দৃশ্য যেন একটি উৎসবের রূপ নেয়। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, সমাজে মানবিকতা ক্রমেই বিলীন হচ্ছে। মানুষকে বিচার করার একমাত্র বৈধ পদ্ধতি হলো আইন-আদালত, কিন্তু আজ সেই বিচার হচ্ছে রাস্তায়, জনতার হাতে। এ পরিস্থিতি এক গভীর সামাজিক অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী আইনকে নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচারব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থার অভাব এ ধরনের ঘটনা বাড়াচ্ছে। যখন উন্মত্ত জনতা সহিংসভাবে নিজেদের রায় কার্যকর করে, তখন তা শুধু একজন ব্যক্তির প্রতি অবিচার নয়, বরং পুরো আইনি কাঠামোকেই দুর্বল করে তোলে। মানবাধিকার সংস্থা আসক (অ্যাসোসিয়েশন ফর সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল সাপোর্ট)-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে জনতার উন্মাদনার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত জনতার হাতে ১৯৯ জন মানুষ নিহত হয়েছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১০ জনে। ২০২৪ সালের মাসভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে ২১, সেপ্টেম্বরে ২৮, অক্টোবরে ১৯, নভেম্বরে ১৪ ও ডিসেম্বরে ১৪ জন মানুষ জনতার হাতে নিহত হয় এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত—জানুয়ারিতে ১৬, ফেব্রুয়ারিতে ১১, মার্চে ২০, এপ্রিলে ১৮, মে মাসে ১৩, জুনে ১১ ও জুলাই মাসে ১৪ জন নিহত হয়েছে। তথ্যগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়, এটি রাষ্ট্রের অকার্যকারিতা এবং জনতার উন্মাদনার ভয়াবহতার প্রমাণ। কয়েক মাসে বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় চোর সন্দেহে দুই ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতদের মধ্যে একজন রিকশাচালক, আরেকজন দিনমজুর। এর আগে ঢাকার মোহাম্মদপুরে ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে এক তরুণ নিহত হন। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, এক মাসে অন্তত ২০ জনের বেশি মানুষ গণপিটুনির শিকার হয়েছে। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে এবং সন্দেহভাজনদের বিচারের জন্য পুলিশের হাতে তুলে না দিলে এ ধরনের নৃশংসতা বাড়তেই থাকবে। এ দৃশ্যগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে আরও নতুন গুজব তৈরি হচ্ছে এবং জনতা উত্তেজিত হয়ে নতুন সহিংসতার দিকে ঝুঁকছে। এ পরিস্থিতি একটি মারাত্মক সাইবার-ঝুঁকি তৈরি করছে। বর্তমানে দেশের সাধারণ মানুষ এক ধরনের স্থায়ী নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করছে। যে কোনো সময় কোনো মিথ্যা অভিযোগে বা গুজবের প্রভাবে একজন মানুষ জনতার হাতে প্রাণ হারাতে পারে। রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব হলো নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্র এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য। রাষ্ট্রকে তার মূল ভূমিকার দিকে ফিরে যেতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষ এবং জবাবদিহিমূলক করা ছাড়া কোনো সমাধান সম্ভব নয়। বিচারব্যবস্থাকে দ্রুত কার্যকর করতে হবে। একই সঙ্গে সমাজে আইন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব প্রতিরোধে প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ নিতে হবে। নাগরিকদের শিক্ষা এবং সচেতনতার মাধ্যমে আইনকে সম্মান করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্রের নীরবতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি একটি গণতান্ত্রিক সমাজের মূল ভিত্তিকেই নড়বড়ে করে দেয়। রাষ্ট্রের উচিত নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। জনতার হাতে বিচার তুলে নেওয়ার প্রবণতা রুখতে কঠোর আইনপ্রয়োগ জরুরি। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এ অরাজকতা থামানো অসম্ভব। মো. নূর হামজা পিয়াস শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ